শেষ আশ্রয়

শেষ আশ্রয়
-চিন্ময় মহান্তী

 

 

“ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং।
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।।”–
সূর্য প্রণাম সমাপন করিয়া ধুতির কাছাটিকে পুনরায় মজবুত করিয়া একবুক জল হইতে উঠিয়া নৃপেন্দ্র চাটুজ্যে বিন্দুর উদ্দেশ্যে বলিলেন , ” বল কি বলবি ? ” বিন্দু গৃহ হইতে যে ভাবিয়া আসিয়াছিল আজই কত্তাকে জবাব দিয়া আসিবে আর ওমুখো হইবে না তাহার সেই সংকল্প কত্তার সম্মুখীন হইয়া কোথায় পলাইয়া কোন গুপ্ত স্থানে লুক্কায়িত হইল তাহা সে বুঝিতে পারিল না । বিন্দু আমতা আমতা করিয়া বলিল , ” বলি কত্তা , টাকাটা দিলে ছেলেটাকে কলেজে ভর্তি করতে পারতাম । ” গামছা দিয়া তৈলচিক্য টাকটি মুছিতে মুছিতে নৃপেন্দ্র গৃহ মুখে অগ্রসর হইতেছিলেন , বিন্দুও তাহার পশ্চাতে পশ্চাতে আসিতেছিল । তাহার কথা শুনিয়া কিঞ্চিৎ চুপ থাকিয়া কত্তা বলিলেন , ” কালই তো তোকে বললাম আগাম টাকা দেওয়া সম্ভব নয় । ” তথাপি বিন্দু থামিতে চাহিতেছিল না , কত্তাকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্তে এমন হেন তৈল নাই যাহা সে লেপন করিতেছিল না । কিন্তু সমস্ত প্রকার তৈলই বিফল হইল । কত্তা গৃহে ঢুকিয়াই আরাধ্য দেবতার পূজা করিতে ঠাকুর ঘরে প্রবেশ করিলেন । বিন্দু নিস্ফল হইয়া চাটুয্যেদের উঠানে বাঁধানো বেদীতে বসিয়া পড়িল । এমতাবস্থায় তাহার পুত্রটিকে কলেজে ভর্তি করিতে কোথায় টাকা পাইবে তাহা চিন্তা করিতে লাগিল । তাহার স্বামী মৃত্যু শয্যায় শায়িত থাকা কালীন যে অন্তিম ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহা সে কিরূপে রক্ষা করিবে এই চিন্তা আসিয়া তাহার মস্তকে ভিড় জমাইয়া জ্বালাতন করিতেছিল । সে একবার ভাবিল টাকা না পাইলে আর কি করিবে একমাত্র পুত্রকে কাহারো ঘরে মুনিষের কাজে লাগাইয়া দিবে , কিন্তু একবার তাহার ইহাও চিন্তা হইল তাহার ছেলেটি ভালো ফল করিয়া দ্বাদশ শ্রেনী উর্ত্তীর্ণ হইয়াছে , তাহাকে উচ্চশিক্ষা হইতে বঞ্চিত করিলে মাতার কর্তব্য পালন হইবে না । পূজার ঘর হইতে ধূপের সুগন্ধ আসিতেছিল , বিন্দু আর একবার কত্তার পায়ে পড়িবে মনস্হির করিয়া সেই বেদীতেই বসিয়া আকাশ পানে চাহিয়াছিল । তাহার আঁখি দুইটি হইতে বিন্দু বিন্দু অশ্রু নিঃসৃত হইয়া একটি ধারা বানাইয়া চিবুক অবধি আসিয়া পড়িয়াছিল ।
গিণ্ণীমা আপন পুত্রের সহিত বাপের বাড়ি হইতে ফিরিলেন । বিন্দুকে বেদীতে বসিতে থাকিতে দেখিয়া এবং তাহার চোখে জল দেখিয়া তিনি জানিতে চাহিলেন , ” কি হয়েছে বিন্দু ? ” বিন্দু গিন্নীমায়ের নিকট সমস্ত ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা করিল । গিণ্ণীমা কিঞ্চিৎ কি যেন ভাবিলেন তাহার পর বলিলেন , ” তুই একটু বোস আমি আসছি । ”
গিন্নীমা হন্তদন্ত হইয়া পূজার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন কর্তা সদ্য পূজা সমাপন করিয়া কুশের আসন হইতে উঠিতেছেন । তিনি পশ্চাৎ ফিরিতেই গিন্নীমার সহিত চক্ষুলাপ হইল । নৃপেন্দ্র বলিলেন , ” কতক্ষণ ফিরেছো ব্রজবালা ? ” ব্রজবালা তাহার প্রশ্নের উত্তর না করিয়া বলিলেন , ” বিন্দু দেখলাম উঠোনের বেদীতে বসে কাঁদছে ? ” নৃপেন্দ্র খানিক বিরক্ত হইয়া বলিলেন , ” ওকে তো বলেই দিলাম এতো টাকা আগাম দেওয়া সম্ভব নয় । ”
” কিন্তু ওর ছেলেটার কথা একবারও ভাবলে না ! ”
” ওদের কথা ভেবে কি হবে ব্রজ ? ওর ছেলে লেখাপড়া শিখলে আমার কি লাভ ? তার চেয়ে বরং লেখাপড়া না শিখলে ভবিষ্যতে আমার ঘরে মুনিষের কাজে লাগবে । যাও গিয়ে রান্নার আয়োজন করো , ওই হাভাতের কথা ভাবতে হবে না । ” বলিয়া নৃপেন্দ্র বারান্দার আলনা হইতে একটি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়া বাহির হইয়া গেলেন । তিনি বিন্দুর নিকটস্থ হইতেই বিন্দু বলিল , ” কত্তা ….!” নৃপেন্দ্র তাহার কথায় কর্ণপাত না করিয়া গাড়িতে চড়িয়া চালকের উদ্দেশ্যে বলিলেন , ‘ চল্ ! ‘ গাড়িটি চলিয়া গেল । বিন্দুর মনে হইল গাড়িতে চড়িয়া একটি অমানবিকতার জ্যান্ত মূর্তি চলিয়া গেল ।
গিণ্ণীমা বাহিরে আসিলেন । বিন্দু তাহার অধোবদন দেখিয়া বুঝিল তিনিও কিছু সুরাহা করিতে পারেন নাই । সে বলিল , ” আমি জানি গিন্নীমা পুরুষের ইচ্ছাধীন নারীকে আপন অনেক ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হয় । ” বিন্দুর এই কথার একটি বৃহৎ মর্মার্থ অনুধাবণ করিয়া ব্রজবালার চোখে জল আসিয়া পড়িল । ‘ আমি আসি গিন্নীমা ! ” বলিয়া বিন্দু বেদী ছাড়িয়া উঠিল । গিন্নীমা নিরুত্তর রহিলেন , বিন্দু ধীর পদক্ষেপে আপন গৃহাভীমুখী হইল । গিন্নীমা আঁচল দিয়া চক্ষু দুইটি মুছিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিলেন তাহার পুত্রটি মেঝেতে একটি খেলনা হেলিকপ্টারের রিমোট লইয়া গবেষণায় মত্ত রহিয়াছে । তাহার মনে একটি ক্ষেদ আসিল , তিনি ভাবিলেন এতো সম্পত্তি থাকিতেও আজ একজন অসহায় মাতাকে তিনি সাহায্য করিতে পারিলেন না । মনের দুঃখ ভুলিতে আপন পুত্রকে ক্রোড়ে করিয়া ছাদে উঠিলেন । তথায় একটি পোষ্য কাকাতুয়া খাঁচায় রহিয়াছিল , পুত্রটি কাকাতুয়ার খাঁচার নিকট বসিয়া সেটির সহিত খেলিতে লাগিল । ইহা দেখিয়া ব্রজবালার মনে হইল খাঁচায় বন্দী কাকাতুয়ার সহিত তাহার কোনরূপ পার্থক্য নাই , তিনিও ইহার মতোই সংসার সমুদ্রে মায়ার খাঁচায় বন্দী ; নিজস্ব কোনো ইচ্ছা নাই কোনো স্বাধীনতা নাই । পূবের রৌদ্র বাড়িতে লাগিল , খবরের কাগজওয়ালা সাইকেলের বেল বাজাইয়া ‘ কাগজ ..’ বলিয়া চিৎকার করিয়া কাগজটি উঠানে ছুঁড়িয়া দিয়া চলিয়া গেল । ব্রজবালা আপন পুত্রকে ক্রোড়ে করিয়া নিচে আসিয়া উঠান হইতে কাগজটি সংগ্রহ করিয়া কর্তার টেবিলে রাখিলেন । পুত্র ভাঙা ভাঙা অক্ষরে বলিল মা … খা …ব …। সদ্য সমাপ্ত দুর্ব্যবহার লইয়া ক্ষেদ বহন করিবার অবকাশ আর ব্রজবালার রহিল না । তিনি পুত্রের ক্ষুধা নিবৃত্তির নিমিত্তে ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন ।
বিন্দু গৃহে প্রবেশ করিয়া স্বামীর অতি প্রিয় কেদারাটিতে ধপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন । তাহার পুত্র কোথা হইতে কয়েকটি কাষ্ঠখন্ড জোগাড় করিয়া নিজের আহারের জন্য উনুন জ্বালাইতেছিল । সে মাতাকে এইরূপ বসিয়া পড়িতে দেখিয়া বলিল , ” কী হলো মা ? কত্তা কি টাকা দিতে রাজি হলেন ? ” পুত্রের প্রশ্ন শুনিয়া বিন্দু চেয়ারের হাতলদুটিতে হাতের ভর দিয়া উঠিতে উঠিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন , ” না ! দিল না ! ” পুত্র মায়ের মনের ব্যথা অনুভব করিয়া বলিল , ” আমরা যে গরীব মা ,আমাদেরকে কি কত্তা বিশ্বাস করবে বলো ; আমাদের তো পরিশ্রম করে ছাড়া শোধ দেওয়ার উপায় নেই ! ”
বিন্দু দেওয়ালে টাঙানো স্বামীর ছবির প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” তোর বাবা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে আজ আমাকে কত্তার কাছে হাত পাততে হতোনা ! ” মাতার চোখে অশ্রু দেখিয়া কি প্রকারে স্বান্তনা দিবে তাহা ভাবিয়া না পাইয়া পুনরায় রন্ধনে নিযুক্ত হইল । কিয়ৎপর মাতা অশ্রু মুছিয়া পশ্চাৎ ফিরিতেই দেখিলেন পুত্র কয়েক গোছা শাক লইয়া বটিতে কুটিতেছে । তিনি বলিলেন , ” ছাড় বাবা ! তুই বরং একবার বিধু মাস্টারের কাছে যা , লোক মুখে শুনেছি উনি নাকি খুব দয়ালু , কিছু একটা ব্যবস্থা করলেও করে দিতে পারেন ! ” ছেলে যে শাকের আঁটিটি কুটিতেছিল তাহার অবশিষ্টাংশ কুটিয়া বঁটি ছাড়িয়া উঠিল । বারান্দার রশি হইতে একটি জামা টানিয়া লইয়া গায়ে দিয়া বাহির হইল । মাতা রন্ধন কার্যে ব্যস্ত হইলেন ।

বিন্দুর ছেলে যখন বিধু মাস্টারের ঘরে আসিয়া পৌঁছাইল তখন বিধু মাস্টার স্কুলে যাইবার জন্য স্নান সারিয়া গামছাটি উঠানে টাঙানো রশিতে মেলিতেছিলেন । বিন্দুর ছেলেকে সম্মুখে দেখিয়া তিনি বলিলেন , ” কি হলো বিভাস ? ” বিভাস বলিল , ” মাস্টারমশায় আমার বোধহয় আর কলেজে পড়া হবে না ! মা ভর্তির টাকা জোগাড় করতে পারেনি ! ”
” আচ্ছা তুই দাঁড়া ” বলিয়া বিধু মাস্টার ঘরে ঢুকিলেন । কিয়ৎক্ষণ পর তিনি কাঁধে একটি কাপড়ের ব্যাগ ঝুলাইয়া বাহির হইয়া বলিলেন , ” চল্ বিভাস । ” বিভাস মাস্টারের মোটরবাইকে চড়িয়া বসিল ।
স্কুলে আসিয়া বিধু মাস্টার হেড মাস্টারের নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত বলিয়া তাহার অনুমতি লইয়া বিভাসকে সাথে করিয়া কলেজের উদ্দেশ্যে চলিলেন । হেডমাস্টার নিকটস্থ সহশিক্ষকদের মুখপানে চাহিয়া বলিলেন , ” এই হেন মানুষটাকে ভগবান সন্তান সুখ হইতে বঞ্চিত করিলেন ! ”
বিধু মাস্টার বিভাসকে কলেজে ভর্তি করিয়া দিলেন । অধ্যক্ষের সহিত কথা বলিয়া বৃত্তির ব্যবস্থা করিয়া দিয়া এবং হোস্টেলে থাকিয়া পড়িবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়া তাহাকে ঘরে পৌঁছাইয়া দিলেন ।
ঘরে ফিরিতেই বিন্দু জানিতে চাহিলেন , ” কিছু ব্যবস্থা হলো বাবা ? ” বিভাস বলিল , ” হ্যাঁ মা । হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থাও হয়েছে । আগামী পরশু হোস্টেলে যেতে হবে । ” তাহার পুত্র এই প্রথম তাহাকে ছাড়িয়া অন্যত্র থাকিবে ইহা ভাবিয়া বিন্দুর কন্ঠ শুষ্ক হইয়া আসিতে লাগিল । কিন্তু তিনি মনে মনে দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ হইতে চেষ্টা করিলেন । যেমন করিয়াই হোউক স্বামীর অন্তিম ইচ্ছা পূর্ণ করিতে হইবে । ভাঙ্গিয়া পড়িলে পুত্রও ভাঙ্গিয়া পড়িবে ইহা ভাবিয়া অন্তরের কষ্ট অন্তরেই চাপিয়া রাখিলেন । মুখে বলিলেন , ” স্নান করে খেয়ে নে বাবা । ” পুত্র স্নানের উদ্দেশ্যে চলিয়া গেল । বিন্দু স্বামীর ছবির নিকট দাঁড়াইয়া বলিলেন , ” ওগো শুনছো তোমার ছেলে পরশু হতে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে । তোমার ইচ্ছে পূরণ হবে । ”

রাত্রি গভীর হইয়াছে । অদূরে কতিপয় সারমেয় থাকিয়া থাকিয়া চিৎকার করিয়া উঠিতেছে । বিন্দুর চোখের পাতা এক হইতেছে না । বিন্দু ভাবিতেছেন কি করিবেন ? কত্তার ঘরে কাজ ছাড়িয়া দিলে উপোস করিয়া মরিতে হইবে আবার গেলেও আপন অসহায়তা প্রকাশ করা হইবে । কিন্তু কিবা করার আছে কত্তা যে বেতন দেন সেই বেতন এই এলাকায় আর কেহই দিতে পারিবে না , না হয় একটু বেশিই খাটিতে হয় । অন্য গৃহস্থে কাজ করিলে বাড়ির ভাড়া দেওয়া দুষ্কর হইয়া উঠিবে । তাহার মনে পড়িল স্বামীর চিকিৎসার জন্য নিজের বাড়ি বিক্রয় করিবার পর স্বল্প ভাড়ার এই গারার বাড়িতে উঠিয়াছিলেন, সেই পাঁচ-সাত বৎসর পূর্বে । আপন সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় করিয়াও স্বামীকে বাঁচাইতে পারেন নাই । স্বামী বেসরকারি ব্যাংকে কার্য করিতেন বলিয়া যে কয়টি টাকা কর্ত্তৃপক্ষের নিকট হইতে পাইয়াছিলেন সেইগুলিও ঋণ মিটাইতে গিয়া নিঃশেষ হইয়া গিয়াছিল । কত্তা আগাম টাকা দিতে অস্বীকার করিয়াছেন ঠিকই কিন্তু বেতন সময় মতোই দিয়া দেন । অবশেষে বিন্দু চিন্তার অবসান ঘটাইয়া ইহা স্থির করিলেন যে যাহার গৃহে দুইবেলা অন্নের সংস্হান করা দুস্কর তাহার সন্মান রাখিলে চলে না , মান -অপমান -অভিমান ইহার ঠাঁই তাহার অন্তরে রাখিতে নাই । যাহাই হোউক তাহাকে কত্তার গৃহে যাইতে হইবে । নানান চিন্তার মধ্যে কখন যে ভোর হইয়া গেল তাহা বিন্দু বুঝিতে পারিলেন তখন যখন পাশের বাড়ির খোঁয়াড় হইতে মুরগির ডাক শুনিতে পাইলেন ।
ঘুম হইতে জাগিয়া বিভাস মুখ ধুইতেছিল । মাতাকে বাহির হইতে দেখিয়া বলিল , ” কোথায় যাবে মা ? ” পুত্রের মুখপানে চাহিয়া মাতা বলিলেন , ” কত্তা বাবুর বাড়ি । ”
” তুমি আবার কত্তা বাবুর ঘরে যাবে ? ” পুত্রের প্রশ্নের উত্তরে বিন্দু বলিলেন , ” ও তুই বুঝবিনা বাবা , পেটের জ্বালা বড় জ্বালা ! ” পুত্র আর কিছু বলিল না । বিন্দু চলিয়া গেলেন ।
গিণ্ণীমা পুত্রকে ক্রোড়ে করিয়া উঠানে একটি কেদারায় বসিয়াছিলেন , বিন্দুকে দেখিয়া তিনি বলিলেন , ” বিন্দু …” । গিণ্ণীমাকে থামাইয়া বিন্দু বলিলেন , ” আপনাদের দয়া কখনো ভুলবো না গিন্নীমা । ” বিন্দুর কথা গিন্নীমার অন্তরে তীক্ষ্ণ শলাকার মতোই বিঁধিল । বিন্দু ইহা বুঝিয়া বলিলেন , ” গিন্নীমা আপনাদেরকে আঘাত দিতে আমি একথা বলিনি । বহু ভেবে দেখলাম দীর্ঘদিন আপনারা বেতন দিয়ে আমার ও আমার ছেলের পেটের অন্ন জোটাচ্ছেন ।” গিণ্ণীমা বাকস্তব্ধ হইলেন । তাহার প্রতি অবিচার করিবার পরও তাহার আনুগত্য এবং ঔদার্য্য দেখিয়া গিণ্ণীমা ভাবিলেন , গরীবের ঘরে আলো না জ্বলিলেও মনের আলো প্রজ্বলিত থাকে । গিন্নীমা মৃদুকন্ঠে বলিলেন , ” রাত্রের এঁটো বাসনগুলো পড়ে আছে । ”
” ঠিক আছে গিণ্ণীমা” বলিয়া বিন্দু বসন ধুইবার নিমিত্তে গৃহাভ্যন্তরে চলিয়া গেলেন । কত্তা বাহিরে কোথাও গিয়াছিলেন , গৃহে ফিরিয়া কলতলায় বিন্দুকে দেখিয়া বলিলেন , ” আমি তো ভাবছিলাম তুই আর আসবি না বিন্দু । ” বিন্দু কোনো উত্তর করিলেন না । কত্তা গিন্নীর উদ্দেশ্যে বলিলেন , ” আমি স্নানের জন্য চললাম । ” গৃহে স্নানের জন্য বাথরুম রহিলেও নৃপেন্দ্র অবগাহন করিয়া স্নানের জন্য পুষ্করিণী যান । এই ব্যাপারে কেহ প্রশ্ন করিলে তিনি বলেন , ” সেই ছোটোবেলায় বর্ণ পরিচয়ে পড়েছি , ” অবগাহন করিয়া স্নান করিবে ,” সেই শিক্ষার মর্যাদা দিয়ে যাচ্ছি । ”

সকাল হইতে বিভাস গোছগাছ করিতেছিল । মাতার মনে বিষন্নতা আসিয়া ভিড় জমাইতেছিল । অবশেষে বিভাস প্রস্তুত হইয়া হোস্টেলে থাকিয়া লেখাপড়া করিবার উদ্দেশ্যে বাহির হইয়া গেল । মাতা ঈশ্বরকে স্মরণ করিয়া বলিলেন , ” ঠাকুর দেখো ছেলেটা যেন মানুষ হয়ে আমার মাথা উঁচু করে । ” ক্ষণিক নিশ্চুপ বসিয়া থাকিবার পর বিন্দু কত্তার ঘরে যাইবার জন্য বাহির হইলেন ।
অদ্য মানষিক বিষন্নতার কারণে কার্যে মন লাগিতেছিল না । কলতলায় বাসন ধুইতে গিয়া কয়টি চায়ের পেয়ালা হাত হইতে ফসকাইয়া শানের উপর পড়িয়া শতটুকরা হইয়া গেল । আওয়াজ পাইয়া হাতের খবরের কাগজটিকে ভাঁজ করিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া বাহিরে আসিয়া নৃপেন্দ্র দেখিলেন বিন্দু পেয়ালার টুকরাগুলি কলের চাতাল হইতে একটি একটি করিয়া তুলিয়া একটি পাত্রে রাখিতেছে । নৃপেন্দ্র একবার স্বপত্নীক রাসের মেলা দেখিতে গিয়া এইগুলি কিনিয়াছিলেন । তাহার পরদিন হইতেই তিনি এই সখের পেয়ালাগুলিতে চা পান করিয়া আসিতেছেন । চোখের সামনে আপনার সখের পেয়ালাগুলির অবধারিত শ্মশান যাত্রা দেখিয়া তিনি রুষ্ট হইয়া বলিলেন , ” সখের তুই কি বুঝিস ! ভাঙবিই তো , টাকা পাসনি কিনা । ছোটোলোক কোথাকার ! ” বিন্দু মৃদুস্বরে বলিল , ” কি করবো কত্তা হাত ফসকে পড়ে গেল , ছেলেটা আজ আমাকে ছেড়ে হোস্টেলে গেল তো তাই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম । ”
” ছেলেটা হোস্টেলে গেল তাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম , যত্তসব ” বলিয়া কটাক্ষ করিয়া নৃপেন্দ্র পুনরায় ঘরে চলিয়া গেলেন । ব্রজবালা আপনার কক্ষের জানালা দিয়া স্বামীর রূঢ় বাক্যবান শুনিতেছিলেন । কত্তা চলিয়া যাইতেই তিনি বাহিরে আসিয়া বিন্দুর নিকট দাঁড়াইয়া বলিলেন , ” বিন্দু তুই কিছু মনে করিস না ! তুইতো জানিস মানুষটা ওরকমই । ” বিন্দু ব্রজবালার মুখের প্রতি চাহিয়া বলিল , ” না গিণ্ণীমা মনে করবো কেন ? ছোটোলোকের যে মন থাকতে নেই গিণ্ণীমা ।” ব্রজবালা ইহার পর কি বলিবেন খুঁজিয়া পাইলেন না । তাহার হঠাৎ মনে হইল বাহিরের লোকের নিকট আপন স্বামীর নিন্দা করা মোটেই ঠিক নয় আবার পরক্ষনেই ভাবিলেন , নিজের রক্তও যদি অন্যায় করে তাহার জন্য অনুতাপ করিবার অপেক্ষা ক্ষমাভিক্ষাই শ্রেয় ইহাতে অন্তরের প্রশান্তি সর্বাধিক । কত্তার মুখ হইতে নির্গত ‘ ছোটোলোক ‘ সম্বোধনটি বিন্দুর হৃদয়ে গাঁথিয়া গেল । তিনি ভাবিলেন খাইতে না পাইলেও আর কত্তার গৃহে জলস্পর্শ করিবেন না । একবার তিনি তাহার সংকল্প ভঙ্গ করিয়াছিলেন পুত্রের কথা চিন্তা করিয়া , পুত্রের যখন একটা উপায় হইয়া গিয়াছে আর কোনো অবস্থাতেই সংকল্প ভঙ্গ করিবেন না , এইরূপ চিন্তা করিয়া বাসনগুলি নামাইয়া দিয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া আপন গৃহে ফিরিয়া আসিলেন ।
দুপুর গড়াইয়া বিকাল হইয়া আসিল । বিন্দুর কোনো কাজে মন লাগিতেছিল না । মনে মনে উপার্জনের একটি উপায় খুঁজিতে লাগিলেন । কিন্তু হতাশ হইয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহিলেন না । তাহার বিশ্বাস এই বলিয়া বদ্ধমূল হইল যে , এতো বৎসর যখন সমস্ত প্রতিকূল বিষয়ের উপায় নিজেই বাহির করিয়াছেন আজিও পারিবেন ।
সূর্য অস্তাচলে যাইতেছিল , শেষ রোদটুকু গায়ে মেখে অনেক উঁচুতে একঝাঁক সাদা বক উড়ে যাচ্ছিল তাদের গন্তব্যের পথে । বিন্দু ঘরের সদর দরজায় তালা দিয়া বাহির হইলেন ।
তরুলতার ঘরে আসিয়া বিন্দু দেখিলেন সে একটি ধবধবে সাদা থান গায়ে জড়াইয়া সন্ধ্যা প্রদীপটি মাজিয়া পরিষ্কার করিতেছে । বিন্দুকে দেখিয়া তরুলতা প্রদীপটি মাজিতে মাজিতেই বলিলেন , ” বিন্দু যে , তা এই অসময়ে কি মনে করে ! ” বিন্দু বলিলেন , ” তুই যে কারখানায় কাজ করিস আমার জন্য একটা কাজ দেখে দে না ভাই , বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছি । ” তরুলতা এইবার হাতের প্রদীপটি নামাইয়া রাখিয়া বলিলেন , ” তুই যে নৃপেন্দ্র চাটুয্যের ঘরে কাজ করছিলি ? ” বিন্দু নৃপেন্দ্রর উপর ক্ষোভ উগরাইয়া বলিলেন , ” আমি অসহায় হয়ে ওর ঘরে কামিনের কাজ করি বলে কি আমাকে ছোটলোক বলতে হবে ! ” এরপরও বিন্দু কিসব বলে গেলেন তাহা তরুলতার কর্ণে প্রবেশ করিল না , তাহার মনে পড়িল তাহার স্বামী এবং বিন্দুর স্বামী যখন একই অফিসে কাজ করিতেন তখন বিন্দু স্বামীর মাইনা বেশি বলিয়া কয়েকটি সোনার গহনা গড়াইয়া তরুলতাকে দেখাইতে তাহার নিকট সেইগুলি পরিয়া বড়াই করিতেন । তাহার অভিলাষ ছিল বিন্দুকে দেখাইয়া দিবেন কিন্তু স্বামীর কম আয়ের জন্য তাহা হইয়া ওঠে নাই । ইহার প্রভাব কিন্তু উহাদের দুইজনের স্বামীর উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই তাহাদের বন্ধুত্ব পূর্ববৎ বজায় রহিয়াছিল । তরুলতা কোনো প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন না দেখিয়া বিন্দু তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন , ” কি ভাই একটা কাজ দেখে দিবি না ! ” তরুলতা আশ্বাস দিয়া বলিলেন , ” বিন্দু , তুই এখন বাড়ি যা আমি দেখি চেষ্টা করে , কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারলে তোকে খবর দেবো । ” ‘ ঠিক আছে ভাই ‘ বলিয়া বিন্দু চক্ষুর আড়াল হইতেই তরুলতা একটা ঝামটা মেশানো স্বরে বলিলেন , ” কাজ দেখবো না ছাই ! তখন তো বড্ড গয়নার গরব দেখাতি ! ” গহনা ব্যতীত অপর কিছু লইয়া যে তাহাদের হিংসা হয় নাই তাহা নহে কিন্তু তরুলতা ইহাকেই অধিক মাত্রায় গুরুত্ব দিয়াছেন । ইহার কারণ নারী জাতির অধিক গহনা প্রীতি , ইহা বলিলে অমূলক হইবে কিনা তাহা শ্রদ্ধেয় পাঠকবর্গ নির্ধারণ করিবেন ।

দীর্ঘ একমাস অতিক্রান্ত হইয়া গেল , ইহার মধ্যে বিন্দুর পুত্র একবার আসিয়া মাকে দেখিয়া গেল কিন্তু তরুলতার নিকট হইতে কাজের কোনো খবর আসিল না । ঘরের মালিক ভাড়া না পাইয়া বারংবার তাগাদা করিতে লাগিলেন । বিন্দু একবার ভাবিলেন নিজে গিয়া তরুলতার নিকট হইতে কাজের খবর লইয়া আসিবেন , সেইমত সন্ধ্যায় বাহির হইয়া তরুলতার ঘরে আসিলেন ; তরুলতা একটি পিঁড়িতে বসিয়া রাত্রের ব্যঞ্জনের নিমিত্তে কয়টি আনাজ কুটিতেছিলেন । বিন্দুকে দেখিয়াই তিনি বলিলেন , ” না ভাই মালিক বলেছে এখন নতুন কাউকে কাজ দিতে পারবে না । ” তরুলতা আর বাক্যব্যয় না করিয়া ঘরে ফিরিলেন । ইলেকট্রিকের বিল সঠিক সময়ে জমা করিতে না পারিবার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল , আন্দাজ করিয়া অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়া কেরোসিনের বাতি জ্বালাইলেন । তাহার মনে হইল এই গৃহ ত্যাগ করাই উচিত হইবে , কতোবার আর মালিককে অজুহাত দিয়া ফিরাইবেন । পুত্রের ব্যবহৃত একটি খাতা লইয়া খুঁজিয়া একটি অব্যবহৃত পাতা ছিঁড়িয়া লিখিতে বসিলেন ,
” বাবা বিভাস,
আমি চিরকাল ঠিকানা বদল করেছি । বাপের বাড়ি থেকে তোর বাবার বাড়ি , সেখান থেকে ভাড়া বাড়ি , এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে , এখন চলেছি কোনো এক রেলস্টেশনে । তোর হোস্টেলের ঠিকানা আমি জানি না তাই চিঠিটা কোথায় পাঠাবো তাও জানি না । বিধু মাস্টারের কাছে দিয়ে গেলাম । বিধু মাস্টার দয়ালু মানুষ উনি হয়তো আমার থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন কিন্তু আর কতো সাহায্য চাইবো ! তাই আমি চললাম অনির্দিষ্ট ঠিকানায় । তুই যেদিন বড় হবি তোর অনেক রোজগার হবে , নিজের বাড়ি হবে সেদিন আমার খোঁজ করিস বাবা । ভালো থাকিস । আমার কথা ভেবে সময় নষ্ট করিসনা বাবা , সন্মান নিয়ে বেঁচে থাকার মতো মানুষ হ ।
ইতি তোর মা ”
চিঠিটি হাতে লইয়া বিন্দু রাত্রির অন্ধকারে ঘর ছাড়িয়া বিধু মাস্টারের ঘরের সামনে আসিয়া দেখিলেন চারিদিকে কেমন একটা নিস্তব্ধতা গোটা বাড়িটাকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে । চিঠিটা মাস্টারের ঘরের সদর দরজার সম্মুখে ফেলিয়া একটি ছোটো পাথর চাপাইয়া তিনি ঘোর অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেলেন ।
সকাল হইয়াছে । মাস্টার নিত্যদিনের ন্যায় অদ্যও ঘুম হইতে জাগিয়া ইষ্টদেবতার মন্ত্র জপ করিয়া ঘরের দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া চিঠিটি দেখিলেন । সেইটি ভালো করিয়া পড়িয়া সযত্নে ভাঁজ করিয়া ঘরে রাখিলেন । মনস্হির করিলেন অদ্যই বিভাসের নিকট সেইটি পৌঁছাইয়া দিবেন । কিন্তু বিভাসের ভাগ্য সুপ্রসন্ন রহে নাই । মুখ ধুইতে গিয়া হঠাৎ করিয়া বিধু মাস্টার পড়িয়া গেলেন আর উঠিলেন না , তিনি এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করিলেন ।

উপরিউক্ত ঘটনার কয়েকদিন পর বিভাস তাহার মাতাকে দেখিতে আসিয়া দেখিল , ঘরে অন্য একটি গৃহস্থ ভাড়া লইয়াছে । সে মালিকের নিকট গিয়া জানিতে পারিল তাহার মাতা কাহাকেও কিছু না জানাইয়া রাত্রির অন্ধকারে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন । এক্ষণে কি করা উচিত স্থির করিতে না পারিয়া সে মাথায় হাত দিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িল , তাহার মা যে কোনো আত্মীয় বাড়ি যাইতে পারেন ইহা সে একবারের জন্যও ভাবিতে পারিল না । বাবার মৃত্যুর পর হইতে কোনো আত্মীয় তাহাদের সহিত যোগাযোগ রাখে নাই । সুদিন হইতে দুর্দিন আসিয়া হাজির হইলে যাহাদের আপন ভাবা হয় তাহার কেমন করিয়া পর হইয়া যায় ইহা বিভাসের প্রত্যক্ষ । তাহার মনে হইল যেভাবেই হোউক মাতাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে , সেইমত নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থান না রাখিয়া চতুর্দিকে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল ।
ঘুরিতে ঘুরিতে ক্লান্ত হইয়া বিভাস রাস্তার পাশে একটি গাছের নিচে বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিল । অদূরে একটি অট্টালিকার নির্মাণকর্ম হইতেছিল । দীর্ঘক্ষণ তাহাকে চিন্তিত মুখে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া একজন মধ্যবয়স্ক নির্মাণকর্মী তাহার নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন , ” বাবা তোমার কি হয়েছে ? এমন করে ঝুমে বসে আছো কেন ? ” বিভাস অধোবদন তুলিয়া নির্মাণকর্মীর মুখপানে চাহিয়া বলিল , ” আমার মাকে খুঁজে পাচ্ছিনা মা হয়তো ………! ” বিভাসের অনুক্ত কথার একটি মর্মবিদারী অর্থ আপন মন মধ্যে স্থির করিয়া নির্মাণকর্মী বলিলেন , ” বাবা , তুমি যদি ইচ্ছা কর আমার সঙ্গে আমার ঘরে চলো সেখানেই তোমার অতীত বৃত্তান্ত শুনবো । ” বিভাস সম্মত হইয়া তাহার সহিত চলিল , যাইতে যাইতে ভাবিল অদ্য হোস্টেল রহিয়াছে কিন্তু পড়াশোনা শেষ হইলে তো আর মাথা গুঁজিবার জায়গা নাই । চাকুরী পাইলে তবেই বাসস্থান গড়িতে পারিবে কিন্তু ততদিন কোথায় রহিবে , পড়িতে পড়িতেই যে চাকুরী হইবে তাহার নিশ্চয়তা নাই ।
নির্মাণকর্মীর ঘরে পৌঁছাইয়া বিভাস দেখিল একটি ঝুপড়ি ঘর । নির্মাণকর্মীর সঙ্গে একটি কমবয়সী ছেলেকে দেখিয়া পাশের ঝুপড়ির এক বৃদ্ধ বলিলেন , ” কিরে শ্যামলা এ তুই কাকে সঙ্গে করে আনলি ? ” শ্যামল বলিল , ” এক অসহায় সন্তানকে । ” বৃদ্ধ আর কিছু বলিলেন না । বিভাস শ্যামলের পিছুপিছু ঝুপড়ির ভেতর প্রবেশ করিল । তাহার চক্ষু স্থির হইয়া গেল , এ সে কি দেখিতেছে ! এ সে কাহাকে দেখিতেছে ! ঝুপড়িতে চাঁদ নেমে এসেছে । বিভাস কিছুতেই চোখ ফিরাইতে পারিতেছিল না । সে ভাবিল কলেজে অনেক মেয়েকেই দেখিয়াছে , তাহাদের কাহারো কাহারো সৌন্দর্য কম রহে নাই তবে কি সে …..। মেয়েটি মৃদুস্বরে পিতার মুখপানে চাহিয়া বলিল , ” বাবা …। ” শ্যামল বলিলেন যা মা খাবার নিয়ে আয় ছেলেটা সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি । বাবার নির্দেশ মান্য করিয়া মেয়েটি খাবার আনিতে পাশের কুঠুরিতে প্রবেশ করিল । কিয়ৎপর খাবার আসিল । বিভাস সেগুলি দ্রুত গিলিতে লাগিল । শ্যামল বলিলেন , ” আহারে ! বাছার খুব খিদে লেগেছিল । ” মেয়েটি অদূরে দন্ডায়মান থাকিয়া বিভাসের প্রতিটি গ্রাস লক্ষ্য করিতেছিল । শ্যামল উত্থাপন করিলেন , ” বাবা বিভাস , তোমার মা তোমাকে ছেড়ে গেলেন কেন ? ” বিভাস মুখের গ্রাসটি গলধঃকরণ করিয়া বলিতে আরম্ভ করিল । তাহার মুখ হইতে অতীত জীবনের ইতিবৃত্ত শুনিয়া মেয়েটির চোখে জল আসিয়া পড়িল । কোথা হইতে একটি মায়া আসিয়া তাহার অন্তঃকরণ বেষ্টিত করিল । বিভাসের থালার ভাত শেষ হইয়াছে দেখিয়া শ্যামল কন্যার প্রতি চাহিয়া বলিলেন , ” মা সুলেখা আর কয়টা ভাত দে । ” সুলেখা তাহার আহারের ভাতগুলি লইয়া আসিল । বাপ বিটির ভাত শেষ হইল , বিভাস তাহা বুঝিতে পারিল না । খাওয়া শেষ করিয়া উঠিয়া বিভাস হাত ধুইতে বাহিরে যাইতেই শ্যামল মেয়েকে বলিলেন , ” অতিথির সৎকার পুণ্যির কাজ , আমার বাপ ঠাকুরদা বলতেন । যা মা ভাত বসা । ” পিতার নির্দেশ মতো মেয়ে ভাত বসাইতে গেল । বিভাস হাত ধুইয়া ঘরে ঢুকিয়া শ্যামলকে বলিল , ” আমি আসি এবার । ” শ্যামল বলিলেন , ” কোথায় যাবে ? ” উত্তরে বিভাস বলিল , ” আমার ঠিকানা হোস্টেলে । ”” বাবা যদি কিছু মনে না করো এই বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করে থাকতে পারো । ” বলিয়া শ্যামল উত্তরের অপেক্ষায় বিভাসের মুখপানে চাহিয়া রহিলেন । বিভাস কিঞ্চিৎ নিশ্চুপ থাকিয়া ভাবিল , ইনি তাহার প্রতি মায়া প্রদর্শন করিতেছেন ঠিকই কিন্তু যাহার ঘরে সমন্ত মেয়ে রহিয়াছে তাহার ঘরে রহিলে পাড়ার লোকের মুখে অচিরেই বদনাম রটিবে , মেয়েটির বিবাহ সম্পন্ন করিতে তখন এই মানুষটিকে যারপরনাই বেগ পাইতে হইবে । সে কোনোপ্রকারেই এই মানুষটির কোনো ক্ষতি করিতে পারিবে না । মুখে বলিল , ” না আমি আমার হোস্টেলেই ফিরে যাবো । ” শ্যামল বিশেষ আপত্তি আর করিলেন না । বিভাস বাহির হইয়া গেল । সুলেখা চৌকাঠে দাঁড়াইয়া দেখিল আকাশটা মেঘলা হইয়া আসিয়াছে ।
ঝুপঝুপ করিয়া বৃষ্টি শুরু হইয়াছে । বিভাস বৃষ্টিতে ভিজিতে ভিজিতে হাঁটিতেছিল । কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইতেই সে দেখিল পিচ রাস্তার উপর জনা কয়েক লোক ছাতা মাথায় দিয়া উৎসুক হইয়া কি একটা ঘিরিয়া রাখিয়াছে । সে কাছে আসিতেই চিনিতে পারিল । তাহার চোখের জল বৃষ্টির জলের সহিত মিশিতে লাগিল । জমায়িত জনতার মধ্য হইতে একজন বলিলেন , ” বেচারা বৃদ্ধা বেপরোয়া লরির শিকার হলেন । কি করবে বাবা অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করো । ” বিভাস তাহার প্রতি চাহিয়া বলিল , ” আমার সে সামর্থ্য কোথায় ? ” তাহার অসামর্থ্যের কথা শুনিয়াই জমায়িত জনতার ভিড় ক্রমশ পাতলা হইতে লাগিল । যে ব্যক্তি অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার বিধান করিয়াছিলেন তিনি বিভাসের কাঁধে হাত রাখিয়া বলিলেন , ” বাবা ভুলে যেও না আজও মানুষ আছে বলে সূর্য প্রতিদিন ওঠে । আমি টাকার ব্যবস্থা করবো । ” বিভাস তাহার সম্মুখে নির্বাক হইয়া করজোড় করিল ।
মাতার যাবতীয় ক্রিয়া কর্ম সম্পন্ন হইয়া গেল । সকলেই চলিয়া গেল , বিভাস সদ্য নেভানো চিতার নিকট বালির উপর বসিয়া স্রোতস্বিনীর তরঙ্গের প্রতি চাহিয়া কি যেন ভাবিতে লাগিল । এইরূপে কিঞ্চিৎ সময় অতিবাহিত হইয়া গেল হঠাৎ বিভাস অনুভব করিল তাহার কাঁধে কেও যেন হাত রাখিল । পিছন ফিরিয়া দেখিল সুলেখার পিতা , সে উঠিয়া দাঁড়াইল । শ্যামল বিভাসের দুই কাঁধ জড়াইয়া বলিলেন , ” বাবা বিভাস সুলেখা তোমার ফেরার অপেক্ষায় চোউকাঠে দাঁড়িয়ে রয়েছে । ” বিভাসের চোখে কয়েক ফোঁটা জল আসিয়া পড়িল , সে মায়ের আঁচল হারাইয়া শেষ আশ্রয় খুঁজিয়া পাইল ।

Loading

Leave A Comment